আমেরিকা , বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫ , ১৯ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
মিশিগানে দ্বিতীয় হামে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত সিলেটে সাবেক এমপি ও মেয়রের বাসায় হামলা, ভাঙচুর প্রথমবার বৈঠকে বসছেন ড. ইউনূস ও নরেন্দ্র মো‌দী ওয়েইন কাউন্টি ট্রেজারার অফিস ভবনে বোমা হামলার হুমকি দুই দফা ভারী বৃষ্টিপাতের পর মেট্রো ডেট্রয়েটে বন্যার আশঙ্কা আজ ফার্মিংটন হিলসে বাড়িতে আগুন লেগে ৪ পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১২ জন আহত নর্থ মিশিগানে ভয়াবহ তুষার ঝড় : ১০টি কাউন্টিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা  ইস্ট ডেট্রয়েটে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে সম্ভাব্য বিস্ফোরণে ১৩ জন আহত পথের ভুলে গুয়াতেমালার এক নারী নির্বাসনের মুখোমুখি ঐতিহাসিক তুষার ঝড়ে বিপর্যস্ত মিশিগানের উত্তরাঞ্চল, বিদ্যুৎহীন ৯০ হাজার মানুষ মিশিগানে এবার একইদিনে ঐক্যবদ্ধ  ঈদুল ফিতর উদযাপনে বাড়তি আনন্দ  যুক্তরাষ্ট্রে আজ ঈদ সৌদি আরবে ঈদ রোববার চীন সফর শেষে দেশে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে কোটি কোটি ডলার কোভিড তহবিল প্রত্যাহার করবে ট্রাম্প প্রশাসন স্পিরিট এয়ারলাইন্স ডেট্রয়েট থেকে আরও ১৫টি নন-স্টপ রুট যোগ করেছে ওয়ারেনে গাঁজার দোকান খোলার অনুমতি দিল সিটি কাউন্সিল  শেখ হাসিনাসহ ৭৩ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা অঙ্গ প্রতিস্থাপনে জলাতঙ্কে মিশিগানের বাসিন্দার মৃত্যু ক্লিভল্যান্ড-ক্লিফস ডিয়ারবর্ন ওয়ার্কস প্ল্যান্টে ৬০০ জন কর্মী ছাঁটাই করবে

সিলেটি গীতের সাহিত্য-মূল্য

  • আপলোড সময় : ২৯-০৩-২০২৫ ০২:১৭:১৭ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৯-০৩-২০২৫ ০২:১৭:১৭ পূর্বাহ্ন
সিলেটি গীতের সাহিত্য-মূল্য
বাংলা লোকসাহিত্যের বর্ণিল বৈভব বৃহত্তর  সিলেটের বিয়ের গীত বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় দীপ্র ।
সাহিত্যের কোমল মধুর রস- সিঞ্চনে
গীতের প্রাণধারা সতত বহমান। 
রবীন্দ্রনাথ বলেন, "অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের ও ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ।"১
অন্যত্র বলেন, "সাহিত্যের অর্থ যা বুঝি সে হচ্ছে নৈকট্য অর্থাৎ সম্মিলন। মানুষকে মিলতে হয় নানা প্রয়োজনে, আবার মানুষকে মিলতে হয় কেবল মেলবার জন্যই,অর্থাৎ সাহিত্যের উদ্দেশ্যে। শাকসব্জির খেতের সঙ্গে মানুষের যোগ ফসল ফলানোর যোগ। ফুলের বাগানের সঙ্গে যোগ সম্পূর্ণ পৃথক জাতের।সব্জি খেতের শেষ উদ্দেশ্য খেতের বাইরে, সে হচ্ছে ভোজ্য সংগ্রহ। ফুলের বাগানের যে উদ্দেশ্য তাকে এক হিসাবে সাহিত্য বলা যেতে পারে। মন তার সঙ্গে মিলতে চায়,সেখানে গিয়ে বসি,সেখানে বেড়াই।"২
উপর্যুক্ত বক্তব্যের নিরিখে গীতকে সাহিত্য বলা যায়। আমরা জানি গ্রাম বাংলার অন্তঃপুরচারী নারী মনই প্রধানত গীতের উৎস ভূমি। তাদের অন্তরের জিনিস ভাবের জিনিস সম্মিলন প্রয়াসী। এ প্রয়াস গীতে সুতীব্র। পাঠক শ্রোতার গভীর অভিনিবেশেই বিষয়টা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। সর্বোপরি গীত নিতল অনুভূতির ঊর্মি মুখর নির্ঝরিণী।  এই নৃত্য চপল তরঙ্গ বিভঙ্গেই গীতাঞ্চল সাহিত্যের রসকান্তিতে দীপ্র হয়ে ওঠেছে।
 গীতের রচয়িতা পল্লীর নিরক্ষর সাধারণ মানুষ। স্বাভাবিক ভাবে অপরাপর লোক সাহিত্যের মত গীতও অলিখিত। মুখে মুখে সতত সঞ্চরমান,পল্লবিত। সংযোজন, বিয়োজন,সংক্ষেপণ,পরিবর্ধন ইত্যাদির মাঝে আপাত দৃষ্টিতে গীত গতানুগতিক। একঘেয়েমি এবং পুনরুক্তি দোষে দুষ্ট। হৃদয়রঞ্জক ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ লাবণ্যময় কাব্যশ্রী গীতে সংস্থাপিত নয়।নিরুপম সৌন্দর্যমণ্ডিত রূপৈশ্বর্য গীতে নেই। এ কারণেই এর পরিপার্শ্ব বর্ণ-বিভঙ্গে পাঠকের অনন্য সাধারণ অভিনিবেশ দাবি করতে পারেনা। শিল্প প্রতিভার প্রযত্নে সৃষ্ট কাব্য কান্তি, বাগ- বৈদগ্ধ্য,মনীষার ঔজ্জ্বল্য, দৃষ্টির স্বচ্ছতা,কল্পলোকের সুদূরতার অনির্বচনীয় মাধুর্য,  সুষমার দীপ্রতা ইত্যাদির অভাব গীতে অত্যন্ত প্রকট। এ কারণেই গীতের সংসর্গে পাঠক-শ্রোতা ক্রমোচ্চ  আবেগে শিহরিত হয়না। স্বর্গীয় সুূধারসে আপ্লুত হতে পারেনা।এরপরও উচ্চকণ্ঠে বলা যায়,গীতের পরিমণ্ডল কাব্যিক বৈভবে বর্ণোজ্জ্বল।

বাংলা সাহিত্যের বৈচিত্র্যময় আসরে গীতের গীতিকার-সুরকারের অবদান কান্তিময়। অনুধ্যান বিশিষ্টতা জ্ঞাপক। বহিরাবরণে কাব্যভোক্তাদের মনোরঞ্জন এবং চিত্তাকর্ষণে গীতের ব্যঞ্জনা সুতীব্র নয় এবং পরিশীলিত বৈদগ্ধের সাথে উন্নত কলা নৈপুণ্যের দ্যোতক না হলেও গীতের কাব্য কুঞ্জে নিভৃতচারী ফল্গুধারার মত গীতি- বেণু অমিয় মাধুর্যে নিরন্তর বেজেই চলছে। গীতের শরীর জুড়ে আভাসিত হয়েছে, বিচ্ছুরিত হয়েছে সাহিত্যের লাবণ্যোজ্জ্বল অঙ্গরাগ। যে সমস্ত উপাত্তের আশ্রয়ে সাহিত্য সুধাগন্ধে হিল্লোলিয়া ওঠে এবার আমরা সেসব পরিচায়নে তৎপর হব।
(শব্দ)-গীতের সুর ঝংকার শব্দ চয়নের বৈচিত্র্যময় আবহে পাঠক শ্রোতাকে আকৃষ্ট করে। গ্রামীণ জীবনের দৈনন্দিনতার কাছাকাছি থেকেও বিচিত্র রকম শব্দ প্রয়োগ গীতের অঙ্গ সুষমাকে মনোহর মসৃণ করে তুলেছে,
(তৎসম) পন্থ, জয়, জল, সুন্দর ইত্যাদি।
(অর্ধ-তৎসম) পিরীত, মিষ্টি, খিদা, বাদ্যি ইত্যাদি।
(তদ্ভব) হাত, পা, মাথা, কান ইত্যাদি।
(দেশি) নেড়া, ঢেঁকি, চাউল, কুলা ইত্যাদি।
বিদেশি
(আরবি) অজু, আতর, আজব, আল্লা ইত্যাদি।
(ফারসি) আওয়াজ, পরি, বিবি, আয়না ইত্যাদি।
(হিন্দি)পানি, আচকান, চুড়ি,পাগড়ি ইত্যাদি।
(পর্তুগিজ) টুপি, সাবান, ফিতা, আলমারি ইত্যাদি। (ইংরেজি) মার্কেট, এরেস্ট, ডিস্কো,চেয়ার ইত্যাদি।
(হিন্দু ঐতিহ্য ভিত্তিক) শ্যাম,কালিয়া, রাধা, মন্দির ইত্যাদি।
(আঞ্চলিক) বইছইন, বেইল, ছাত্তি, পোলা ইত্যাদি।

(ভাষা) ভাবের বাহন ভাষা। লোকজীবনাশ্রয়ী শব্দের বিন্যাসে গীতের ভাষার লৌকিক দিকটাই সমধিক পরিস্ফুট হয়েছে।পাণ্ডিত্য বর্জিত সাধারণ মানুষের প্রাণের আকুতি এবং কথায় গীত সহজ, সরল এবং প্রত্যক্ষ।বহুল ব্যবহৃত মুখের ভাষা গীতকে কৃত্রিমতা মুক্ত রেখেছে। বৃহত্তর জনজীবন সম্পৃক্ত ভাষায়,অনুভূতিতে, রুচিতে, জীবনচিত্রে গীত সমৃদ্ধ। গীতের ভাষা আকাশ বিহারী কল্পনার অলঙ্কারহীন সাদামাটা। সোঁদা মাটির গন্ধযুক্ত অকৃত্রিম লোকসমাজের ভাষা।এ ভাষা অনাড়ম্বর প্রসাধনচর্চিত নয়। কাব্য সৌকর্যে,শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় ব্যঞ্জিত নয়।কৃত্রিম, দুর্বোধ্য বা দুরুচ্চার্য নয়। মানুষের হৃদয়ানুভূতির অকপট প্রকাশ এ ভাষার প্রাণ। সাহিত্যানুশীলন গীত রচয়িতাদের জীবন চর্যার অঙ্গীভুত ছিলনা। তাদের কেউই বিদগ্ধ সাহিত্য রসিক হিসাবে খ্যাত ছিলেন না। তাদের ভাব চিত্র অংকন যথাযথ এবং প্রাসঙ্গিকভাবে সন্নিবদ্ধ নয়। এরপরও বলতে হয়, তাদের ভাষা আয়াসহীন, স্বতঃস্ফূর্ত। প্রকৃতির স্বাভাবিক সৌন্দর্যে বেড়ে ওঠা অরণ্যলতার মত। একারণেই শব্দ নির্বাচনে, ভাষা মাধুর্যে গীত লীলায়িত,তরঙ্গিত,হিল্লোলিত না হলেও এর সহজ সরল রূপশ্রী এক অন্যরকম প্রদীপ্তি লাভে সমর্থ হয়েছে।
(ধ্বনি) ধ্বনি কাব্যের নিয়ামক। " কাব্যের সংজ্ঞা নির্ণয়ে কেউ কেউ বলেছেন-' ধ্বনিরাত্মা কাব্যস্য বা বক্রোক্তি জীবিত।"...ধ্বনিবাদীদের মতে, যে ছন্দোবদ্ধ কবিতায় বাচ্য অপেক্ষা বাচ্যাতীতই প্রধান হয়ে ওঠে, বাচ্যার্থ অপেক্ষা ব্যাঙ্গার্থেই প্রাধান্য সূচিত হয়-সেই রচনাই আদর্শ কবিতা।৩' এ উক্তির নিরিখে গীত সাহিত্য পদবাচ্য। তবে উচ্চাঙ্গের কবিপন্থা বিষয়ে গীতিকাররা পরিজ্ঞাত ছিলেন না-তাদের  সহজাত প্রবণতার পরিপোষণেই গীতের সৃষ্টি। নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর আবেগ- অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত উৎসার গীতের প্রাণ। এই প্রাণেই গীতের বিশিষ্টতা। সুতরাং ধ্বনি বিচারে আমরা বলতে পারি,সাহিত্যের মহাসিন্ধুর দুর্নিবার কলকল্লোলে গীত ঊর্মি মুখর না হলেও স্বতোবিকশিত সারল্য ও অনায়াস সরসতায়ই গীতের স্বতন্ত্র্য শিল্পমূল্য।
(সুর) রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'ছন্দে, শব্দে, বাক্য বিন্যাসে সাহিত্যকে সংগীতের আশ্রয়তো গ্রহণ করতেই হয়।যাহা কোনোমতে বলিবার জো নাই, এই সংগীত দিয়াই তাহা বলা চলে। অর্থ বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলে যে কথাটা যৎসামান্য, এই সংগীতের দ্বারাই তাহা অসামান্য হইয়া উঠে। কথার মধ্যে বেদনা এই সংগীতই সঞ্চার করিয়া দেয়।'৪

নিরক্ষর সমাজের মৌলিক সাহিত্যের অঙ্গীভূত বিয়ের গীত আনুপূর্বিক গতানুগতিক সুরে গীত হলেও সহজ সরল প্রাণের ছোঁয়ায় শ্রোতা সাধারণের কাছে মোটেও মূল্যহীন বলে মনে হয়না। এর সুর কৃষি নির্ভর সমাজ মানস থেকে অকপট সারল্যে স্ফূর্ত হয়েছে। গূঢ়ার্থ বা তত্ত্বের বাইরে নিভৃত পল্লীর সরল অন্তঃকরণ সরল সুরেই নবতর লাবণ্যে গীতে অভিব্যক্ত হয়েছে বলে আমাদের ধারণা।
(নিসর্গ)-শিল্প সাহিত্যের সাথে নিসর্গ সুগভীর ভববন্ধনে সংলিপ্ত। মূলত প্রকৃতি চেতনা বাংলা কাব্যের অঙনে বহু পুরনো এক ঐতিহ্য বিশেষ। গীতের মানস ভূমিতে নিসর্গের কোমল মধুর আলিম্পন মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে। অনিবার্যভাবেই গীতে বিধৃত চিত্তব্যাকুলতার অনুষঙ্গ হয়ে এসেছে নানারকম প্রাকৃতিক উপাদান। চন্দন, লবঙ্গ, এলাচি, জায়ফল, জৈত্রী, দূর্বা, হলদি, সুন্দা, মেথি, ধান, তামাক ইত্যাদিসহ বহু বিচিত্র গাছপালার সাথে লেবু গাছের উপস্থিতি লক্ষণীয়ভাবে দৃষ্ট হয়-.'লেম্বুর তলে থাইকাগ বালি তাম্বুয়া টাঙ্গাইন।'
নিসর্গের অনুপম সৌন্দর্যের উপাদান পাহাড়, ফুল, নদী ইত্যাদিও গীতে রস-নিবৃত্তির আধার হয়ে এসেছে-.'সাতালি পর্বতেরে
পাঞ্চ ডক্কি বাজেরে।'(পর্বত)
.'দুইটি চাম্পার বদলে
হাজার চম্পা দিমুরে।' (ফুল)

ষড় ঋতুর লীলা বৈচিত্রের এদেশে প্রতিটি ঋতু আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে। কেউ রুদ্র-ভীষণ, কেউ আবার কোমল মধুর। কেউ ডালা ভরে আনে হাজার ফুলের সৌন্দর্য। কেউ শোনায় পাতা ঝরার গান। গীতে ঋতুগত প্রভাব, প্রকৃতির রূপ বদলের চিত্র বারবার চোখে পড়ে। বৈশাখ মাসের খর রোদ্দুর অর্থাৎ গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড দাবদাহের প্রসঙ্গ এসেছে এভাবে-
'চৈত্ না বৈশাখের মাসও
রইদের বড় জ্বালা।'
(রস) রস সম্পর্কে অতুল চন্দ্র গুপ্ত বলেন, 'কাব্যের আত্মা এ সবের অতিরিক্ত আনন্দ স্বরূপ বস্তু। অর্থাৎ  রস।'৫
এই রস সহৃদয়জনের আনন্দময় মানসিক অবস্থা মাত্র। কাব্যপাঠ সহৃদয় পাঠকের মনে কাব্যের অনুরূপভাব সঞ্চারিত করিয়া তাহাকে এমন এক নৈর্ব্যক্তিক ও আদর্শ জগতে লইয়া যায় যে, তখন তিনি সেখানে তদগত হইয়া পড়েন। ফলে,কাব্যের ভাবানুভূতির সহিত তাহার একাত্মতা সৃষ্টি হয়।...এই দিব্য অনুভূতি সঞ্জাত নির্মল আনন্দময় অবস্থাই রস।৬

'বিশ্বনাথ কবিরাজ তাঁর 'সাহিত্য দর্পণ' গ্রন্থে সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে নয়টি রসের কথা বলেছেন, শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র,বীর,ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত ও শান্ত।'৭
আমরা অনুভব করি গীতাঞ্চল প্রায় সর্বপ্রকার রসের কলগুঞ্জনে মুখর।
এবার কয়েকটা দৃষ্টান্ত চয়ন করব।
(শৃঙ্গার) রসের আসরে শৃঙ্গার রসই প্রধান। নর-নারীর আসক্তি জনিত এ রসের বেগবান ধারায় গীতাঞ্চল বিশেষ ভাবে অভিসিঞ্চিত।
(হাস্য) হাস্যরস সৃষ্টিতে গীতের গীতিকাররা পারঙ্গম। 'আসমানের তেরা'রূপ দামান শ্বশুর বাড়িতে এসেছে। সাথে ভাই, ভাবিসহ আরও অনেকে। বরের ভাই সম্পর্কে কনে পক্ষের মন্তব্য-
'আইলারে দামান্দের ভাই হিজলের মুড়া-
টুনকি দিলে মাটিত পড়ে গতরের গুঁড়া।'
(করুণ) করুণ রসের বেদনা বিধুর গুঞ্জরণ গীতের মূল উপজীব্য। ক্রন্দনসিক্ত অন্তর্দাহের তীব্রতা লোক মানসের গহন মনের অর্গল খুলে গীতের কথা ও সুরে বারবার ঝঙ্কৃত হয়েছে।পরিশীলিত রূপাল্পনায় ঋদ্ধ না হলেও সহজ সরল অনাড়ম্বর ভাষায় হৃদয়ানুভূতির অকপট ব্যাকুলার্তি শ্রোতার হৃদয়কে স্বাভাবিক ভাবোচ্ছ্বাসে আকুল করে তোলে। এ রস অনাবিল প্রসন্নতা হয়ত দাবি করতে পারেনা।কিন্তু' কানের ভিতর দিয়া মরমে' ঠিকই প্রবেশ করে-
'দাদি, নানি, চাচা, চাচি, কান্দইন জারে জার-
আমরার সোনার ঘর আন্ধাইর হইয়া যায়।'
(রৌদ্র)ক্রোধ থেকে এ রসের উৎপত্তি। নারী নির্যাতন অংশে এ রস স্বতস্ফূর্ত উৎসারে উৎসারিত। আমরা একটা উদাহরণ চয়ন করব। স্ত্রীর প্রতি ক্রোধান্বিত স্বামীর উক্তি-
'ঘরের পিছে জালি না সুন্দিবেত
তারে কাটি ভাঙিমু গুমান।"
(বীর)
পাত্রের গুণ, বীরত্ব, শক্তিমত্তা বিচারে হরিণ শিকারের শর্ত দেয়া হলে সাহসী তরুণ বীরত্বের সাথে-
'কুছে লইল গুলিরে হাতে লইল গুলাইলরে
তেসরা গুলাইলে হরিণ মারিয়া ফালাইলনারে।'
(ভয়ানক) এ রসের উৎস ভূমি ভয়। গীতে অসহায় নারী মনের ভয়ার্ত চিত্র অস্তাচলের   বিধুরতায় বেদনা-নীল। মেয়েকে পরের ঘরে দিয়ে মায়ের মন বিকম্পিত। তাঁর হৃদয়াকাশে কাঁদনঘন মেঘের আলিম্পন-
'ঢোলের বাড়ি শুনিয়াগ
পাইকের নাচন দেখিয়াগ
কাইপ্যা উঠে বালির মার পরানিগ।'
(শান্ত)
যেখানে সুখ-দুঃখ, রাগ,দ্বেষ প্রভৃতি থাকে না সেখানে শান্ত রসের আস্বাদ পাওয়া যায়। যেমন,মন্দমধুর হাওয়ায় আন্দোলিত সুপারি গাছের নীচে গোসলরত কইন্যার অঙ্গশ্রী যখন হলুদ আলিম্পনে দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে তখন শোনা যায় শান্ত রসের কলগুঞ্জন-
'আরসের আবার বাড়িতগ কাংকনি গুয়াগ বাতাসে অলঅলি করে।
তারি তলে আবুইদ্যা বুয়াইগ হলুদি গোসল করে।'
(বীভৎস)
ঘৃণা বা জুগুপ্সা থেকে এ রস উপজাত।এ রসের ধারা গীতের প্রান্তরে দুর্বার বেগে বহমান। আমরা যখন যৌতুকলোভী পাত্র বা পাত্রপক্ষের দেখা পাই তখন স্বাভাবিকভাবেই মনে ঘৃণা জন্মায়।
শ্রান্ত ক্লান্ত কিশোরী বধূ গভীর ঘুমে বিভোর।কিন্তু হৃদয়হীন বরের মন আর দেরি সয়না। তাই অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে-
'কতই ঘুম ঘুমাইনগ বিবি দুই নয়ন ভরিয়া
তুমারও বাবাজি কি কি দিছইনগ বিবি
দেও মোরে সমজাইয়া।'
(অদ্ভুত) এ রসের বিধায়ক হল মনের বিস্ময়কর অনুভূতি। গীতের পাত্র যখন আপন শক্তিমত্তা প্রমাণে কাঞ্চা বাঁশ আর গুলির সাহায্যে বাঘের মত মহাপরাক্রম ও শক্তিশালী  প্রাণীকে অবলীলায় হত্যা করতে সমর্থ্য হয় তখন গীতল বর্ণনায় অদ্ভুত রসের আস্বাদ পাওয়া যায়-
'তিনগুলি খাইয়া বাঘুনি উত্তরে সিনান হয়
পড়লা বাঘুনি সুরমা নদীর পাড়ে।'
(ছন্দ)
উৎকৃষ্ট কবি কর্ম ছন্দদোলায় লীলায়িত ও মনোগ্রাহী।এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'কথাকে তার জড় ধর্ম থেকে মুক্তি দেবার জন্যই ছন্দ। সেতারের তার বাঁধা থাকে বটে, কিন্তু তার থেকে সুর পায় ছাড়া, ছন্দ হচ্ছে সেই তার বাঁধা সেতার।কথার অন্তরের সুরকে সে ছাড়া দিতে থাকে।'৮

'ড.সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, 'বাক্যস্থিত পদগুলিকে যেভাবে সাজাইলে বাক্যটি শ্রুতিমধুর হয় ও তাহার মধ্যে একটা কালগত ও ধ্বনি গ
ত সুষমা উপলব্দ হয়, পদ সাজাইবার সেই পদ্ধতিকে ছন্দ বলে। সুনীত কুমারের সংজ্ঞার্থে ছন্দের বৈশিষ্ট্য প্রায় সবই ধরা পড়েছে।'৯
গীতে প্রধানত স্বরবৃত্ত ছন্দেই ভাবনা, কল্পনা,বক্তব্য অভিব্যক্ত হয়েছে-
'সাজাও কন্যা সুন্দর করি ঝিলমিল ছিটাইয়া।
দামান মিয়া দেখে যেন পাগল যায় হইয়া। '(স্বরবৃত্ত)
'আইব দামান সাজিয়া   বৈরাত আইব নাচিয়া
লীলাবালির বিয়ার বাজনা উঠিল বাজিয়া।
ঘরভরা নাইওরি  আইছইন আরিপরি
কইন্যার ভাবি দেখ দেখ বাইর অইলা সাজিয়া। (ত্রিপদী)
(অলঙ্কার)
সাহিত্য শ্রুতিসৌকর্য বিধায়ক। অলঙ্কার বিষয়ে ভারতীয় মনীষীদের মধ্যে যাঁর নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য-তিনি আচার্য দণ্ডী। এ বিষয়ে আবিষ্কৃত গ্রন্থগুলির মধ্যে প্রাচীনতম আচার্য্য দণ্ডীর কাব্যাদর্শ-ষষ্ঠ শতাব্দী। দণ্ডী অলঙ্কারকে বলেছেন,'কাব্যের সৌন্দর্য বিধায়ক ধর্ম্ম(attribute)। কাব্য শোভা করান ধর্ম্মান অলঙ্কারাণ প্রচক্ষতে'...তাঁর কাব্যাদর্শ আজও বহুমানিত।
আচার্য বামন বলেন, কাব্যং গ্রাহ্যম অলঙ্কারাৎ।'১০
অলঙ্কার দু'রকম- শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার। নিরক্ষর গীতিকাররা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে গীতের যে বাক-প্রতিমা নির্মাণ করেছেন তাতে উভয়বিধ অলঙ্কার দীপিত হয়ে আছে। গীতের শরীর যে সমস্ত অলঙ্কারে বিভাসিত তা থেকে কিছু উদাহরণ চয়িত হল-
১.'দূর ঐ তনি আইলারে
সোনার মতন দামানরে।'(উপমা)
২.'আপন দেশে গিয়া কইন্যা চাইর দিকে চায়-
আইজ বুঝি বাবাজীর মন্দির আন্ধাইর  হইয়া যায়।' (অন্ত্যানুপ্রাস)
৩.'কও কও কওগ ভেলুয়া এজিন কবুল কওগ-
বও বও বওগ ভেলুয়া শীতল পাটির উপরেগ।' (আদ্যানুপ্রাস)
৪, .'গাছের পাতা কান্দে গাঙ্গের পানি কান্দে
কান্দন শুনি লিলুয়া বাতাসে।' (সমাসোক্তি)
৫, 'নতুন জামাই বর সাজিয়া চাইলা বর দাদার টাইন
মুচকি হাসইন দাদা মুখে হুক্কা লইয়া।' (যমক)
৬. কচু পাতা যেমন কাঁপে মাইজীর পরাণ তেমন কাঁপে।'(উৎপ্রেক্ষা)
উপর্যুক্ত সাহিত্যোপকরণগুলো ছাড়াও অতলান্ত অনুভূতি গীতকে সাহিত্যিক বৈভবে দীপ্র করেছে। এর মূলে আছে এর সর্বজনীন আবেদন। গীত সর্বজনের মনোজগতে অনায়সেই প্রবেশ করতে পারে।এর কারুণ্য, বাস্তবমুখিতা,বক্তব্য এবং রূপৈশ্বর্য প্রাণে প্রাণে সঞ্চরণশীল।যা এক প্রাণের সাথে বহু প্রাণের গীতল সংসর্গ স্থাপন করে।এই সম্মিলন একান্তই মানবীয় এবং এ কারণে রমণীয়ও। এ বিষয়ে কাজী মোতাহার হোসেন বলেন," সাহিত্যিক যে দৃষ্টিতে ঘটনা বা ভাবপুঞ্জের দিকে দৃষ্টি করিয়া থাকেন তাহার ফলে এগুলি তাঁহার অন্তঃকরণে পরিপুষ্ট লাভ করিয়া এক অনির্বচনীয় সর্বজন মনোহারী রূপ পরিগ্রহ করে। এই অন্তর রসের অভিষেকেই যাহা ব্যক্তিগত তাহা সর্বজনীন হইয়া উঠে; যাহা ক্ষণকালীন অনুভূতি তাহা চিরকালীন সৌন্দর্যে রূপান্তরিত হইয়া যায়।
সাহিত্যিক সত্যদ্রষ্টা;তিনি ঘটনা ও ব্যক্তির অন্তঃস্থলে প্রবেশ করিয়া অন্যের অপরিদৃষ্ট অতি নিগূঢ় সম্বন্ধাদি নির্ণয় করিয়া পরিচিতকে অভিনব এবং অকিঞ্চিৎকরকে অসাধারণত্ব দান করিয়া থাকেন। সাহিত্যিকের তুলি-স্পর্শেই পাঠকের মনের অস্পষ্ট চিত্র,সৌন্দর্য সৌষ্ঠবে পুষ্টাঙ্গ হইয়া অভাবনীয় সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। এজন্য উচ্চাঙ্গের সাহিত্য দৃশ্যতঃ বহিরাশ্রিত হইলেও,গভীরভাবে আত্মাশ্রিত এবং গভীরভাবে আত্মাস্থিত বলিয়াই সর্বজনের অন্তঃগ্রাহ্য হইবার মর্যাদা লাভ করিয়া থাকে। "১১ কথাটা গীতের বেলায়ও প্রযোজ্য।
গীত পাণ্ডিত্য বর্জিত এবং অনায়াস সহজতায় কৃত্রিমতা মুক্ত। প্রকৃতির জলহাওয়ায় পরিপুষ্ট সবুজ ঘাসের মত।
মর্তের মানুষের সুখ-দুঃখ,হাসি-কান্না, চাওয়া-পাওয়া অর্থাৎ মাটির পৃথিবীর জীবনচর্যায় গীতের মূল সুর গুঞ্জরিত। এ গুণেই গীত কাব্যগন্ধী।আর এর হাত ধরেই আমরা পৌঁছে যাই সাহিত্যের পুষ্পিত, সুরভিত দারুচিনি দ্বীপের দেশে।
তথ্যসূত্র
১. সাহিত্যতত্ত্ব, সম্পাদনা মাহবুবুল আলম, ১৯৮৭,পৃ৬
২. পূর্বোক্ত,পৃ৫৮
৩. আব্দুল আজিজ আল আমান, পদক্ষেপ, কলকাতা, পৃ ৮
৪.  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র রচনাবলি,৪র্থখণ্ড,২০০৪,পৃ৬৪
৫. অতুল চন্দ্র গুপ্ত, কাব্য জিজ্ঞাসা, ১৯৮৭,পৃ৩৬
৬. শ্রীশ চন্দ্র দাস, সাহিত্য সন্দর্শন, ২০০৮, পৃ৪৪
৭. ড. সুবোধ চৌধুরী, সাহিত্যিকা, কলকাতা, ১৯৯৬, পৃ৬৩
৮.  ড. হায়াৎ মামুদ,ভাষা শিক্ষা,   ২০০১,পৃ৫৪৭
৯.  পূর্বোক্ত,২০০১, পৃ৫৪৭
১০.  শ্রী শ্যামাপদ চক্রবর্তী, অলঙকার চন্দ্রিকা, কলকাতা, পৃ৮
১১.  কাজী মোতাহার হোসেন রচনাবলি,১মখণ্ড,১৯৮৪, পৃ১১৫

(সূত্র : সিলেটের বিয়ের গীত, জাহান আরা খাতুন) 
 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan

কমেন্ট বক্স
সিলেটে সাবেক এমপি ও মেয়রের বাসায় হামলা, ভাঙচুর

সিলেটে সাবেক এমপি ও মেয়রের বাসায় হামলা, ভাঙচুর